শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড । আর শিক্ষক শিক্ষার মেরুদন্ড । শিক্ষকদের আচার আচরণ, নীতি নৈতিকতার উপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রভাবিত হয়। আগেও তাই হয়েছে এখনও তাই হচ্ছে। ভবিষ্যতেও তাই হবে। কিন্তু নৈতিকতা বিরোধী কাজকর্মের জন্য শিক্ষক সমাজের উপর দুর্নাম আসছে।
আসলে যারা এ ধরনের নৈতিকতা বিরোধী কাজকর্ম করছেন তাদের শিক্ষকের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ শিক্ষক হতে গেলে যে গুণাবলী অর্জন, যে মূল্যবোধ থাকা প্রয়োজন তা তাদের নেই। তাই পেশাগতভাবে সে শিক্ষকতা করলেও আসলে শিক্ষক হওয়ার কোন যোগ্যতাই তাদের নেই। তাই গুটিকতক লোভী ও নীতিহীন শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ দায় নিতে পারে না।
আজ শিক্ষার মান নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে তার দায় শিক্ষকরা এড়াতে পারে না। কারণ প্রশ্ন ফাঁস নামক একটি অসৎ কাজের পেছনে গুটিকতক শিক্ষক নামের কুলাঙ্গার জড়িয়ে রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে ছাত্রছাত্রীদের ভাল রেজাল্ট হয়তো হচ্ছে কিন্তু মেধার বারোটা বেজে যাচ্ছে যা সে বুঝতে বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এভাবে শুধু সে পিছিয়ে পড়ছে তা না দেশটাকেও পিছিয়ে দিচ্ছ্ েকারণ দেশে হাজার হাজার মেধাহীন জনশক্তির চেয়ে অল্পসংখ্যক মেধাবী থাকা উত্তম। তাই শিক্ষার মেরুদ ভেঙে যারা দেশটার অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি।
শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশে সামগ্রিকভাবে একটা সমালোচনা চলছে। অনেক দিন আগে থেকেই মেধাবীদের মূল্যায়ন ও শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পাসের হার বৃদ্ধির সাথে সাথে কতটা মেধাবী শিক্ষার্থী বের করতে পারছি তা নিয়েই মূলত প্রশ্ন রয়েছে। কারণ ভাল ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন মেধা পরীক্ষায় হতাশ করার মত ফলাফল করছে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি দেশের জন্য কোন সুখকর খবর না। কিন্তু সেটাই ঘটে চলেছে।
কয়েক বছর আগে থেকেই অনেকেই দেশের মেধাবীদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলে আসছেন। মেধা মূল্যায়নের সাথে সাথে কয়েকটা বিষয় নিয়ে মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রয়োগে দক্ষতার অভাব, পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, আনাচে কানাচে ব্যঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন এবং অধিকাংশ পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁস এসব এখন শিক্ষার সাথে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে।
কোন মতেই যেন এর থেকে বের হতে পারছি না। কথায় আছে সর্ষের ভেতরই যদি ভূত থাকে তাহলে ওঝা ঝাড়বে কোথায়। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িয়ে আছে নীতিহীন শিক্ষক যাদের কাছে প্রশ্ন না, বিবেক না, মেধা না মূল লক্ষ্য হলো পকেট ভারী করা। জড়িয়ে আছে বড় বড় সাইনবোর্ডের আড়ালে শিক্ষা ও মেধা নিয়ে ব্যবসা করা কোচিং সেন্টার আর আছে যে কোন মূল্যে সন্তানের ভাল রেজাল্ট নিশ্চিত করা কিছু অভিভাবক ও অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজেই।
এইচএসসি পরিক্ষা চলছে। এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। কিন্তু অভিভাবক মহল চিন্তিত এই ভেবে যে পরীক্ষাটা নির্বিঘেœ শেষ হবে তো। নাকি কোন এক পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হবে। অন্তত গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া পিএসসি বা জেএসসি পরীক্ষায় এটি নিয়মিত চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্র-ছাত্রীরা সত্যি সত্যি পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ রেখে কোথায় প্রশ্ন পাওয়া যাচ্ছে তা খুঁজতে সময় নষ্ট করছে। শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় অনেক অভিভাবকও সন্তানের ভাল ফলাফলের আশায় সেসব ফাঁস হওয়া প্রশ্নের খোঁজে ছুটেছেন। কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রশ্ন ফাঁস রোধ করার জন্য কম চেষ্টা করেনি। আগামী বছর থেকে স্থানীয়ভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রশ্ন ছাপানোর বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
নিজের পকেট ভারী করে দেশের মেধা বিসর্জন দিতে কার্পণ্য করছে না এসব অকাল কুষ্মান্ডরা। মেধা দিয়ে তো আর তাদের বাড়ি গাড়ি হবে না। রেজাল্টের পাশে গোল্ডেন জিপিএ থাকবে না। তাই টাকা দিয়েই কিনতে হবে। আর প্রশ্ন ফাঁসকারীরাও এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। টাকা তো তাদের চাই-ই। তাই তো প্রশ্ন বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছে। বাজারে যারা ব্যবসা করে তাদেরও একটা নীতি আছে বলে মনে হয়। কিন্তু যারা আগেই প্রশ্ন বিক্রি করে তাদের নীতির বালাই আছে বলে মনে হয় না। দেশের মূল সম্পদ কোনটি প্রশ্ন করলে আমার এককথার উত্তর মেধাবীরা।
একমাত্র মেধাবীরাই পারে দেশের বাকী সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে জাতির মেধাকে ধ্বংস করে কোনদিন উন্নয়ন আশা করা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষভাগে এসে যখন পাকিস্তানীরা যখন দেখলো যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত তখন বেছে বেছে তারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে স্বাধীন হলেও যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে আমরা আরো এগিয়ে যেতাম নিশ্চিত। আমার কাছে প্রশ্ন ফাঁস করে জাতির মেধাবী সন্তানদের মেধা বিকশিত হওয়ার আগেই মেরে ফেলাটাও সেরকম জঘন্য কোন অপরাধ বলে মনে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এটা তার থেকেও বড়। কারণ যাদের মেধা বিকাশের সুযোগ না দিয়ে চৌর্য বৃত্তি করে পরীক্ষার ফলাফল কেনা হলো তার মেধা আর কোনদিন বিকশিত না হবারই কথা। সে সারাজীবন এই অবস্থা থেকে বের হতে পারবে কি না সন্দেহ।
]
এই বাঙালিরাই বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বুকে মেধা, দক্ষতা আর গৌরবের সাক্ষর রেখেছেন। সাহিত্য , সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খেলাধূলা সর্বপরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাঙালি এবং বাংলার কথা জ্বলজ্বল করছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সহ কত নাম মেধার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। এই নাম কিন্তু আপনা আপনি বা হালের রেওয়াজ প্রশ্ন ফাঁস করে সম্ভব হয়নি। প্রকৃত মেধা আর যোগ্যতার বলেই এসব করতে পেরেছি।
আমরা যখন পড়াশোনা করতাম তখন প্রশ্নপত্র ফাঁস তো দুরের কথা স্যারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দাগিয়ে আনতেও ভয় পেতাম। ভয় পেতাম এই ভেবে যে পাছে অন্য ছাত্র বলে প্রশ্ন না আঁকিয়ে আনলে পরিক্ষায় মোটেই ভাল করতে পারতাম না। আর এখন অনেকেই ফোন দিয়ে জিগ্যেস করে ভাই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে না কি! এটা যেমন ছাত্রছাত্রীরা করে তেমনি এক শ্রেণির অভিভাবকরাও এবারে করেছে। সবাই চায় নিজের সন্তান যেন ভাল ফলাফল করে। কিন্তু নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে ভাল ফলাফল ভবিষ্যতের জন্য কতটা ভাল এটা বুঝতে পারা জরুরি।
অবশ্য যারা এই অশুভ প্রক্রিয়া চালায় তারা শুধু জেএসসি বা এসএসসি নয় বরং চাকরির পরীক্ষাগুলোতেও যে একই চেষ্টা অব্যাহত রাখে সে কথা বলাই বাহুল্য। একটি জাতির মেধাকে ধ্বংস করে দেবার এর চেয়ে আর ভালো উপায় আর কি হতে পারে? জানিনা এর পেছনে কারা জড়িত আর কেনই বা আমাদের আগামী প্রজন্মকে আমরা এমন পঙ্গু করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছি।
আমার কষ্ট লাগে এইসব ছেলেমেয়েদের জন্য। এতদিন চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমরা ধরেই নেই কোথাও না কোথাও প্রশ্ন ফাঁস হবেই। তবে সেখান থেকে স্কুল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে এ আমি স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারিনা। আমাদের জাতিকে এভাবে মেধাশূন্য করার পেছনে যারা কাজ করে যাচ্ছে তাদের খুব দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ছাত্রছাত্রী থাকবে , শিক্ষক থাকবে , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে তবে লেখাপড়া করার বা করানোর খুব বেশি দরকার হবে না। রাত জেগে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ারওা দরকার হবে না। আর সেটা হলে আমরাই বড় বিপদে পড়ব।
প্রশ্ন ফাঁস কেন হয়? যদি এই প্রশ্ন থেকে সমাধানের চেষ্টা করি তাহলে পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে যে দুটি পরীক্ষা হয় সেদিকে তাকানো দরকার। এবং এই বিষয়টি অনেক আগে থেকেই ঘটে আসছে। আসল কথা হলো প্রশ্ন শিক্ষকদের প্রণয়ন করার কথা থাকলেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তা পাবলিশার থেকে কিনে আনে। এর কারণ মূলত দুটি। এক. প্রাইভেট শিক্ষকরা যাতে তার প্রাইভেটের ছাত্র-ছাত্রীকে কমন না ফেলতে পারে দুই. শিক্ষকরা পরিশ্রম করতে চান না। প্রশ্ন তৈরি করা অনেকের কাছেই একটা বোঝা। তাইতো গাইডগুলো বহাল তবিয়তে বাজারে চলে। কারণ খোদ শিক্ষকরাই তো সেগুলো থেকে প্রশ্ন করে। আবার সরাসরি কমনও পড়ে। ভাবা যায়, সৃজনশীল প্রশ্নও কমন পড়ে।
প্রাইভেট ব্যবসা অনেক পুরাতন এবং এটি বহাল তবিয়তেই চলছে। এখন যারা যে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে পরীক্ষার আগে সেইসব শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন অনেকেই আগে থেকেই বলে দেন। আজ যে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে তার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে টাকা। আজকের শিক্ষার্থীদের পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এবেলা ওবেলা তাদের প্রাইভেট কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। কোচিং সেন্টারগুলো এবেলা-ওবেলা পরীক্ষা নিয়ে এ প্লাস পাওয়ানোর শর্তে ছাত্রছাত্রীদের কোচিং সেন্টারে টেনে আনে।
এখানে দায় শুধুমাত্র কোচিং সেন্টারকে দিলেই হবে না। খানিকটা অভিভাবকের ওপরও পড়ে। যারা দিনরাত লেখাপড়া, বেশি বেশি পরীক্ষা আর পরীক্ষায় অন্তত গোল্ডেন এ প্লাসকে সামাজিক মর্যাদা বলে মনে করেন। তাতে তার সন্তানের যাই হোক না কেন। মাঝে মাঝে পরীক্ষায় অকৃতকার্র্য ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহননের খবর আসে। তাদের আসলে বোঝানো হয় যে ফেল করা মানে সব কিছু শেষ হওয়া।
আসলে কি তাই? পাস ফেল স্বাভাবিক বিষয়। যে পরিশ্রম করবে সে ভাল ফল করবে আর যে তা করবে না তার ফল খারাপ হবে। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করে ভাল ফলাফল করার কোন বীরত্ব নেই। প্রশ্ন ফাঁস হওয়াতে মেধাবী জাতি নিয়ে আমরা শংকিত। মেধাবী জাতি গঠনে তাই শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন আবশ্যক।
লেখক ঃ প্রাবন্ধিক